হযরত ওমর (রাঃ)-এর ন্যায়ের গল্প
হযরত ওমর (রাঃ)-এর ন্যায়ের গল্প
ইসলামের ইতিহাসে ন্যায়বিচারের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম—হযরত ওমর ইবন আল-খাত্তাব (রাঃ)। তিনি ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা এবং খিলাফতের সময়কালে ইসলামী রাষ্ট্রের বিস্তার, প্রশাসন এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় তার অবদান অতুলনীয়। তাঁর শাসনামলে যে বিচারব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তা যুগ যুগ ধরে মানব সভ্যতার জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।গল্পের শুরু
একদিন, হযরত ওমর (রাঃ) মদিনার রাস্তায় হাঁটছিলেন। খলিফা হয়েও তিনি কখনো রাজকীয় পোশাক পরতেন না, বরং সাধারণ মানুষদের মতো চলতেন-ফিরতেন। তিনি প্রায়ই রাতের বেলা ছদ্মবেশে শহরের অলিগলি ঘুরে দেখতেন, যাতে জানতে পারেন, জনগণ কেমন আছে, কেউ কোনো কষ্টে আছে কিনা।
এক রাতে, তিনি শহরের প্রান্তে গিয়ে দেখতে পেলেন, একটি তাঁবুর ভেতর থেকে একটি নারীর কান্নার আওয়াজ আসছে। তিনি ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে শুনলেন, সেই নারী তার ছোট ছেলেমেয়েদের শান্ত করতে চেষ্টা করছেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তিনি দেখতে পেলেন, সেই নারী একটি হাঁড়িতে পানি বসিয়ে রেখেছেন, আর বলছেন, "বাচ্চারা, একটু অপেক্ষা করো, খাবার রান্না হচ্ছে।" কিন্তু হাঁড়িতে ছিল শুধু পানি ও কিছু পাথর।
হযরত ওমর (রাঃ) বুঝলেন, এই মা তার সন্তানদের ক্ষুধা ভুলিয়ে রাখতে এমন করছেন। তিনি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “হে মা, কি হচ্ছে এখানে?”
নারীটি না জেনে যে তিনি খলিফার সাথে কথা বলছেন, বললেন, “আমাদের অভাব-অনটনের মধ্যে দিন যাচ্ছে। খলিফা ওমর তো আমাদের দিকে তাকান না। তাই এই রকম দুর্দশায় আছি। বাচ্চারা ক্ষুধায় কাঁদছে, তাই তাদের শান্ত করতে পানি গরম করছি যেন মনে করে কিছু রান্না হচ্ছে।”
হযরত ওমর (রাঃ)-এর চোখে জল এসে গেল। তিনি কিছু না বলে দ্রুত মদিনার খাদ্য গুদামে চলে গেলেন। সেখানে নিজ হাতে এক বস্তা আটা, কিছু ঘি, খেজুর, মাংস এবং কিছু অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নিলেন। গুদামরক্ষী বললেন, “হে আমীরুল মু’মিনীন, আপনি বললেই আমি এইগুলো পৌঁছে দেই।”
কিন্তু হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, “না, আমি নিজেই নিয়ে যাব। তুমি কি কিয়ামতের দিন আমার বোঝা বহন করবে?” তিনি নিজের কাঁধে সেই ভারি বস্তা তুলে নিলেন এবং রাত্রির অন্ধকারে হেঁটে সেই নারীর তাঁবুর সামনে পৌঁছালেন।
মানবতার নিদর্শন
হযরত ওমর (রাঃ) নিজ হাতে আগুন জ্বালালেন, খাবার রান্না করলেন, এমনকি নিজ হাতে শিশুদের খাওয়ালেন। মা এবং শিশুদের মুখে যখন হাসি ফিরে এলো, তখন তিনি সন্তুষ্ট হলেন। এরপর তিনি চুপচাপ চলে গেলেন, কোনো পরিচয় না দিয়ে।
পরদিন, সেই নারী শহরের একজনের মুখে জানতে পারলেন যে, যিনি গত রাতে সাহায্য করেছিলেন, তিনি আর কেউ নন—নিজে খলিফা হযরত ওমর (রাঃ)। লজ্জায় ও কৃতজ্ঞতায় নারীটির চোখে জল এসে গেল। তিনি পরে শহরে এসে খলিফার জন্য দোয়া করেন।
ন্যায়বিচারের আরেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
একবার মিসরে হযরত ওমর (রাঃ)-এর শাসনামলে এক ক্রীড়ানুষ্ঠানে মিসরের গভর্নর আমর ইবনে আসের ছেলে একজন কপ্টি (খ্রিস্টান) যুবককে ঘোড়দৌড়ে হারানোর পর চাবুক দিয়ে মেরে দেন। সেই কপ্টি যুবক দূর পথ পাড়ি দিয়ে মদিনায় এসে খলিফার দরবারে অভিযোগ করেন।
হযরত ওমর (রাঃ) সঙ্গে সঙ্গে আমর ইবনে আস এবং তার ছেলেকে মদিনায় তলব করেন। তারা এলে হযরত ওমর (রাঃ) সেই কপ্টি যুবককে একটি চাবুক হাতে দিয়ে বলেন, “তুমি এখন প্রতিশোধ নাও। তুমি ওকে যেভাবে আহত করেছে, তুমিও ঠিক তেমনি করে মেরে প্রতিকার নাও।”
ছেলেটি মারার পর হযরত ওমর (রাঃ) গভর্নরকে বললেন, “তোমার সন্তানকে অন্যায় করার সাহস কে দিলো?” এরপর বিখ্যাত উক্তিটি বললেন:
"হে আমর! মানুষকে তুমি কবে থেকে দাস বানালে, যখন তাদের মায়েরা তাদের মুক্ত অবস্থায় জন্ম দিয়েছে?"
এই ন্যায়বিচার মিসরের জনগণের মধ্যে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সৃষ্টি করেছিল ইসলামের প্রতি।
সাধারণ মানুষের অধিকার
হযরত ওমর (রাঃ) সবসময় মনে করতেন, খলিফা হওয়া মানে রাজা হওয়া নয়, বরং জনগণের খেদমতগার হওয়া। তিনি বলতেন, “যদি দজলার তীরে একটি কুকুরও ক্ষুধায় মরে, আমি দায়ী হবো কিয়ামতের দিন।” এই কথার গভীরতা আজকের বিশ্বেও শাসকদের জন্য একটি বড় শিক্ষা।
তাঁর সময়ে বিচারব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ। কোনো ধনী বা ক্ষমতাবান ব্যক্তি অপরাধ করলে, তার জন্য আলাদা কোনো ছাড় থাকত না। আইন সবার জন্য সমান ছিল। তিনি বারবার বলতেন, “ন্যায় প্রতিষ্ঠা করো, যদিও তা তোমার নিজের বিরুদ্ধে যায়।”
শেষ কথা
হযরত ওমর (রাঃ)-এর শাসনকাল ছিল মাত্র ১০ বছর, কিন্তু সেই দশ বছরে তিনি যেভাবে ন্যায়, মানবতা ও সততার মাপকাঠি তৈরি করেছেন, তা আজও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের শেখায়, কিভাবে একজন শাসক, এক জন নেতা বা এক জন সাধারণ মানুষও ন্যায়ের মাধ্যমে সমাজে আলো ছড়াতে পারে। তিনি ছিলেন এক হাত শক্তিশালী প্রশাসক, অন্য হাতে অসহায়ের আশ্রয়দাতা।
আজকের সমাজে যখন আমরা ন্যায়ের অভাবে কষ্ট পাই, তখন হযরত ওমর (রাঃ)-এর মতো নেতৃত্ব ও দৃষ্টান্ত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আদর্শ শাসক কেমন হওয়া উচিত।
কোন মন্তব্য নেই