Header Ads

তোতা পাখি ও দোকানি।

 তোতা পাখি ও দোকানি।

 


বাংলার এক ছোট্ট শহরে একটি জনবহুল বাজার ছিল। সেই বাজারের এক কোণে ছিল ‘হাসান মিঞার পসরা’ নামে একটি ছোট মুদি দোকান। দোকানটি খুবই জনপ্রিয় ছিল, কারণ হাসান মিঞা ছিলেন একেবারে সৎ, ন্যায্যদামে জিনিস বিক্রি করতেন এবং সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন।

হাসান মিঞার একমাত্র সঙ্গী ছিল একটি তোতা পাখি। পাখিটিকে তিনি আদর করে নাম দিয়েছিলেন “মিঠু”। মিঠু ছিল অসম্ভব বুদ্ধিমান। হাসান মিঞা ছোটবেলায় এক ঝড়ের রাতে মিঠুকে আহত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে উদ্ধার করেছিলেন। তারপর থেকে মিঠু তাঁর জীবনসঙ্গী হয়ে ওঠে।

মিঠুর কথা বলার ক্ষমতা ছিল মানুষের মতোই পরিষ্কার। সে “আসসালামু আলাইকুম”, “ধন্যবাদ”, “ভাল আছেন?”, “চিনি এক কেজি, চাল দুই কেজি” — এমন কত রকম বাক্য শিখে ফেলেছিল! দোকানে যখন ক্রেতারা আসতেন, মিঠু তাদের স্বাগত জানাত এবং মাঝে মাঝে হাসান মিঞার হয়ে জিনিসপত্রের নামও বলে দিত।

বাজারের সবাই মিঠুকে খুব পছন্দ করত। এমনকি বাচ্চারা এসে শুধু পাখিটাকে দেখতে দোকানের সামনে ভিড় করত। হাসান মিঞাও খুশি ছিলেন যে তাঁর দোকানে এমন এক সাথি আছে যে ব্যবসায়ও সহায়তা করে এবং মনও ভালো রাখে। 

দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা

একদিন দুপুরের দিকে, দোকানটা একটু ফাঁকা ছিল। হাসান মিঞা তখন পাশের চায়ের দোকানে গিয়ে এক কাপ চা খেতে গিয়েছিলেন। এমন সময় হঠাৎ করে দোকানে ঢুকে পড়ে এক মাতাল লোক। সে দোকান ঘেঁটে ঘেঁটে কিছু জিনিস নিতে থাকে। মিঠু বারবার চেঁচাচ্ছিল, “না না, চুরি করা যাবে না!”, “দে দে, ফেরত দে!”, কিন্তু মাতাল লোকটি পাত্তা দিল না।

রেগে গিয়ে মিঠু তাকে ঠোকর দিতে গেল। কিন্তু মাতাল লোকটি হঠাৎ এক ধাক্কা দিয়ে পাখিটিকে এমনভাবে দেয়ালে ছুঁড়ে মারে যে মিঠু জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারপর লোকটি কিছু শুকনো খাবার আর কিছু টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়।

হাসান মিঞা ফিরে এসে দেখতে পান তাঁর প্রিয় মিঠু নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। তিনি অঝোরে কাঁদতে থাকেন। দ্রুত এক পশুচিকিৎসককে ডাকেন। ডাক্তার এসে মিঠুকে দেখে বলেন, “পাখিটার মাথায় আঘাত লেগেছে, বাঁচবে তবে সময় লাগবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা, ওর কথা বলার ক্ষমতাটা আপাতত হারিয়ে ফেলেছে।”

এই কথা শুনে হাসান মিঞা যেন ভেঙে পড়েন। যে পাখিটি তাঁর দুঃখের সাথি, ব্যবসার সঙ্গি, সে আর কথা বলতে পারছে না!

মৌন মিঠুর নতুন জীবন

এরপর কেটে যায় কয়েক মাস। মিঠু ধীরে ধীরে সুস্থ হয়, আবার খাবার খায়, উড়ে বেড়ায়, হাসান মিঞার কাঁধে বসে। কিন্তু আর কখনও একটি শব্দও মুখ দিয়ে বের করে না। দোকানের নিয়মিত ক্রেতারা মিঠুর নীরবতা দেখে অবাক হয়, খারাপ লাগে। হাসান মিঞা সব ব্যাখ্যা দেন, কিন্তু তিনি মিঠুকে আগের মতো পায় না।

তবে মিঠু বদলে গেল এক ভিন্নরকমে। এখন সে মানুষের মুখ, ব্যবহার, আচরণ খেয়াল করে। কিছু চোর-চালাক ক্রেতা দোকানে এসে বেশি মাল নিয়ে কম দাম দিতে চাইলে, মিঠু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, আর ঠোঁট নাড়ায় — যেন বলে, "সব বুঝেছি, এবার ঠিক হয়ে যাও।"

বাচ্চারা আসলে সে মাথা নাড়ে, কিন্তু কথা বলে না। হাসান মিঞা অনেক চেষ্টা করলেন তাকে আগের মতো কথা শেখাতে, কিন্তু মিঠু আর কথা বলে না।

দোকানে ফের অশান্তি

একদিন বিকেলে আবার এক সন্দেহজনক লোক দোকানে আসে। সে হাসান মিঞাকে ব্যস্ত রাখে নানা প্রশ্ন করে, আর পাশ থেকে দ্রুত এক প্যাকেট চায়ের সাথে কৌটা করে ড্রাই ফ্রুট পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে। মিঠু তখন তাকিয়ে ছিল।

যখন লোকটি বের হতে যায়, তখন মিঠু হঠাৎ উড়ে গিয়ে লোকটির মাথায় এক ঠোকর মারে। লোকটি ভয় পেয়ে পকেট থেকে জিনিস ফেলে দেয়। চারপাশের মানুষ তখনই বিষয়টি বুঝে ফেলে। লোকটিকে ধরে ফেলে এবং থানা পুলিশের হাতে তুলে দেয়।

সবার মুখে তখন একটাই কথা:
“এই পাখি কথা না বললেও এখন অনেক বেশি বোঝে।”

নৈতিক শিক্ষা

এরপর থেকে মিঠু হয়ে ওঠে এক নীরব অভিভাবক। সে আর কথা বলে না, কিন্তু চোখে, আচরণে বলে দেয় অনেক কিছু। হাসান মিঞা এখন বুঝে গেছেন — সব সময় মুখ দিয়ে কথা বলা দরকার হয় না। নীরবতা কখনো কখনো আরও বেশি বলিষ্ঠ ভাষা হতে পারে।

গল্পটি বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। আশেপাশের দোকানিরাও বলে,
“কথা বলা তো সহজ, কিন্তু সময়মতো কাজ করাটাই আসল। মিঠু সেটাই আমাদের শিখিয়েছে।”


শেষ কথা:
এই গল্পটি আমাদের শেখায়— কথা বলার ক্ষমতা হারালেও, কর্ম এবং সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে একজন বা একটি প্রাণীও অনেক বড় দায়িত্ব নিতে পারে। সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া নীরবতাকেও অর্থপূর্ণ করে তোলে।

 

 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.