হযরত মুহাম্মদ (সা.)
হযরত মুহাম্মদ (সা.)
হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানবজাতির শ্রেষ্ঠ আদর্শ, যাঁর চরিত্র, আচরণ ও নীতিবোধ সর্বোচ্চ মাত্রার। তিনি ছিলেন সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং বিশ্ব মানবতার প্রতীক। তাঁর জীবনের অন্যতম গৌরবময় গুণ ছিল—সত্যবাদিতা। এমনকি নবুওয়তের আগেই তাঁর সততা, বিশ্বস্ততা ও সৎচরিত্রের কারণে মক্কার অধিবাসীরা তাঁকে "আল-আমীন" (বিশ্বস্ত) ও "আস-সাদিক" (সত্যবাদী) নামে ডেকে থাকত।
শৈশব থেকেই সততার দৃষ্টান্ত
হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম হয় ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে, সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে। পিতা আব্দুল্লাহ তাঁর জন্মের আগেই ইন্তেকাল করেন। মাতাও শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। এতিম হয়েও তিনি কখনো অসত্য, অন্যায় বা অন্যের সম্পদের প্রতি লোভ দেখাননি। প্রতিটি কাজে তিনি সততা বজায় রাখতেন।
তাঁর শৈশবকাল থেকেই মক্কার মানুষ তাঁর আচরণে খুশি থাকত। তিনি কখনো কারো আমানতের খিয়ানত করেননি, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেননি, মিথ্যা বলেননি। ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলার মধ্যেও সততার পরিচয় দিতেন।
ব্যবসায়ে সততার আদর্শ
যুবক অবস্থায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) একজন সৎ ও সফল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি খাদিজা (রা.) এর মালামাল নিয়ে সিরিয়া পর্যন্ত ব্যবসায়িক সফরে যেতেন। এই সফরেই তিনি তাঁর সততা, পরিশ্রম ও চমৎকার ব্যবস্থাপনার গুণে খাদিজার মন জয় করেন। পরবর্তীতে খাদিজা (রা.) তাঁকে বিয়ে করেন।
তাঁর সততা ও ন্যায়পরায়ণতা এমন ছিল যে, অন্য ব্যবসায়ীরা যেখানে মিথ্যা বলত, ওজনে কম দিত, গ্রাহকদের প্রতারিত করত—তিনি সেখানে সব সময় পরিষ্কার ও নির্ভরযোগ্য ছিলেন। তাঁর সততার কারণে লোকেরা তাঁকে বিশ্বাস করত এবং তাঁর কাছে নিজেদের মূল্যবান জিনিস ও সম্পদ আমানত রাখত।
নবুওয়তের পূর্বে সত্যবাদী পরিচয়
নবী হওয়ার আগেই মক্কার জনগণ তাঁর চরিত্র সম্পর্কে এতটাই নিশ্চিত ছিল যে, কোন বিরোধ মীমাংসার জন্য তাঁকে সালিস বানাত। একবার কাবা শরীফ পুনঃনির্মাণের সময় হজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে কুরাইশদের মধ্যে তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হয়। সকল গোত্র চায় তারা পাথরটি স্থাপন করবে। এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিলে সিদ্ধান্ত হয়, পরদিন যিনি সর্বপ্রথম হারাম শরীফে প্রবেশ করবেন, তাঁকেই সালিস মানা হবে। তখনই প্রবেশ করেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। সকলে আনন্দিত হয়ে বলে ওঠে: “এ তো আস-সাদিক! আল-আমীন!” এরপর তাঁর বিচক্ষণতায় তিনি নিজ কাপড়ের উপর হজরে আসওয়াদ রাখেন এবং প্রত্যেক গোত্রের প্রতিনিধি একসঙ্গে কাপড় ধরে পাথরটি নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যায়। এরপর তিনি নিজ হাতে তা স্থাপন করেন।
নবুওয়তের পর সত্যের আহ্বান
৪০ বছর বয়সে হযরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়ত লাভ করেন। তখন তিনি আল্লাহর আদেশে তাওহিদের আহ্বান নিয়ে মক্কার লোকদের ডাক দেন। তিনি বলেন: “তোমরা যদি আমাকে পাহাড়ের ওপারে একটি সৈন্যদল আসছে বললে বিশ্বাস করতে, তবে আমি যা বলছি—তা আরও বেশি সত্য।” লোকেরা সমস্বরে বলেন, “হ্যাঁ, আমরা কখনোই তোমাকে মিথ্যা বলতে শুনিনি।”
তাঁর এই জীবনের প্রতিটি ধাপে সত্যের উপর দৃঢ় অবস্থান ছিল। তিনি মিথ্যার বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান গ্রহণ করতেন। তিনি বলতেন: “সততা কল্যাণের দিকে নিয়ে যায়, আর কল্যাণ জান্নাতের দিকে।” আবার, “মিথ্যা পাপের দিকে নিয়ে যায়, আর পাপ জাহান্নামের দিকে।”
নির্যাতনের মধ্যেও সত্যবাদিতা
নবুওয়তের পরে তিনি নানা রকম কষ্ট ও নির্যাতনের মুখোমুখি হন। কুরাইশরা তাঁকে মিথ্যাবাদী বলার চেষ্টা করে, কিন্তু নিজেরা জানত যে, তিনি কখনো মিথ্যা বলেননি। তাঁর দাঈত্বের বিরোধিতাকারীরাও তাঁর সততা অস্বীকার করতে পারেনি।
তাঁকে প্রলুব্ধ করে কুরাইশরা একাধিক প্রস্তাব দেয়—ধন, নারী, রাজত্ব—শুধু তিনি যেন দাওয়াত বন্ধ করেন। কিন্তু তিনি বলেন:
“আল্লাহর কসম! যদি তারা আমার এক হাতে সূর্য ও অন্য হাতে চাঁদ রাখে, তবুও আমি এ দাওয়াত থেকে সরে আসব না, যতক্ষণ না আল্লাহ তা বিজয়ী করেন অথবা আমি এতে ধ্বংস হই।”
এই কথাগুলো তাঁর সত্যপ্রিয়তা ও ঈমানি দৃঢ়তার প্রতীক।
মদিনায়ও সত্যবাদিতার আদর্শ
হিজরতের পর মদিনায় তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হন। সেখানেও তিনি সত্য ও ন্যায়ের উপর অবিচল ছিলেন। তিনি অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেন, নিজের ঘনিষ্ঠ কেউ হলেও। মদিনায় তিনি যে ইসলামি সমাজ গঠন করেন, তা ছিল সততা, ইনসাফ ও পরস্পরের অধিকার রক্ষার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
একবার এক মহিলা চুরি করে ধরা পড়লে লোকেরা তার শাস্তি লঘু করার জন্য সুপারিশ করে। তখন তিনি বলেন:
“তোমার আগে যদি কেউ এই কাজ করত, এবং তার উপর শাস্তি কার্যকর না হতো, তবে আজ আমি তোমাদের মধ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারতাম না। আল্লাহর কসম! আমার কন্যা ফাতিমা (রা.) চুরি করলেও আমি তাঁর হাত কেটে দিতাম।”
সত্যবাদিতার শিক্ষা
হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর উম্মতের জন্য সত্যবাদিতার অনুপম শিক্ষা রেখে গেছেন। তিনি সব সময় তাঁর সাহাবিদের সত্য বলার উপদেশ দিতেন। তিনি বলতেন:
-
“তোমরা সবসময় সত্য বলো, কারণ সত্য কল্যাণের দিকে নিয়ে যায়।”
-
“এক ব্যক্তি সত্য বলতে বলতে সে আল্লাহর কাছে সত্যবাদী হিসেবে লিখিত হয়ে যায়।”
তাঁর সাহাবিরাও এই শিক্ষা গ্রহণ করে জীবন চলার পথে সত্য ও ন্যায়ের আদর্শ অনুসরণ করতেন।
উপসংহার
হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সত্যবাদিতা শুধু তাঁর যুগের জন্য নয়, বরং সব যুগের মানুষের জন্য অনুকরণীয়। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে সত্যকে আঁকড়ে ধরতে হবে। আজকের সমাজে যেখানে মিথ্যা, প্রতারণা ও অন্যায়ের ছড়াছড়ি—সেখানে তাঁর জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের জীবন গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
আমরা যদি সত্যকে জীবনের মূলনীতি বানাই, তবে ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সব স্তরে ন্যায়, শান্তি ও প্রগতি নিশ্চিত হবে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন তাই চিরন্তন আলোকবর্তিকা—সত্যের, ন্যায়ের, এবং মানবতার।
কোন মন্তব্য নেই