Header Ads

আলোর পথের সন্ধানে

 

গল্পের নাম: “আলোর পথের সন্ধানে”

গ্রামের নাম ছিল নূরনগর। শান্ত-সুন্দর একটি গ্রাম, যেখানে মানুষজন সাধারণ জীবনযাপন করত। সেই গ্রামের এক কোণে বাস করত ছেলেটি—রাইহান। বয়স প্রায় বারো বছর। রাইহানের বাবা ছিলেন একজন কৃষক, আর মা গৃহিণী। পরিবারটি খুব বেশি অভিজাত না হলেও ছিল দারুণ পরহেজগার। প্রতিদিন ভোরবেলা রাইহানের বাবা তাকে ডেকে তুলতেন ফজরের নামাজের জন্য।

কিন্তু রাইহান একটু অলস ছিল। নামাজের জন্য ডাকলে সে কখনো উঠে পড়ত, কখনোবা উঠতে গড়িমসি করত। কোরআন পড়তে বসলে মনোযোগ ধরে রাখতে পারত না। তার মন সবসময় খেলাধুলা আর বন্ধুদের সঙ্গেই ব্যস্ত থাকত। তার মা বহুবার বুঝিয়েছেন, “বাবা, আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব পালন করাই একজন মুসলমানের প্রথম কর্তব্য। নামাজ, কোরআন—এগুলো আমাদের রুহানিয়াতের খাদ্য।” কিন্তু ছোট বয়সে কে-ই বা এসব বোঝে!

একদিন বিকেলে রাইহান বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে খেলতে হারিয়ে গেল পাশের বনের দিকে। সময় পেরিয়ে গেল, সন্ধ্যা হয়ে এলো। গ্রামের আযান শুনে সবাই নামাজে ব্যস্ত, আর রাইহান তখন গভীর বনের মাঝে পথ হারিয়ে বসে আছে। গাছের পাতা দিয়ে সূর্যের আলো ঢেকে গেছে, চারদিক অন্ধকার আর পাখিদের ডাক শুনে তার বুক কাঁপছে। হঠাৎ সে একটা শব্দ শুনতে পেল। যেন কেউ পাতার ওপর পা দিচ্ছে—“চাপ চাপ চাপ।”

ভয়ে রাইহান গাছের পেছনে লুকিয়ে গেল। হঠাৎ সে দেখতে পেল, এক বৃদ্ধ লোক ধীরে ধীরে হেঁটে আসছেন। পরনে সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। তার হাতে একটি লাঠি। বৃদ্ধ লোকটি চোখে চোখ পড়তেই বললেন, “তুমি এখানে কী করছো, বাছা?”

রাইহান কাঁপা গলায় বলল, “আমি… আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি।”

লোকটি হেসে বললেন, “আল্লাহর নামে বলো, ভয় পেও না। আমি তোমায় নিরাপদে গ্রামে পৌঁছে দেব।” রাইহান কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে গেল।

চলতে চলতে বৃদ্ধ লোকটি কথা বলতে লাগলেন, “জানো বাছা, এই অরণ্যেও যারা আল্লাহকে স্মরণ করে, তাদের ভয় নেই। আল্লাহ বলেন— ‘فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ’—তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ করব। যারা আল্লাহর পথে চলে, আল্লাহ তাদের কখনো একা ফেলে দেন না।”

রাইহান বিস্ময়ের সঙ্গে শুনতে লাগল। সে নিজের ভুল বুঝতে পারছিল। আসলে তার যতটা ভয় পাওয়ার কথা ছিল, ততটা সে পাচ্ছে না—এই মানুষটির কথা শুনে তার মনে একধরনের শান্তি আসছে।

লোকটি আবার বললেন, “ছোট বেলায় যদি আল্লাহর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলো, বড় হয়ে কখনো হারাবে না। এ দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। আমাদের প্রকৃত জীবন হলো আখিরাতের জীবন। সেখানেই আমাদের প্রকৃত পুরস্কার কিংবা শাস্তি।”

অবশেষে রাইহান গ্রামের সীমানা দেখতে পেল। তখন আকাশে তারারা জ্বলছে। গ্রামের মসজিদ থেকে মাগরিবের আযান ভেসে আসছে। রাইহানের চোখে পানি চলে এলো। বৃদ্ধ লোকটি বললেন, “তুমি বাড়ি ফিরে যাও, আর প্রতিজ্ঞা করো—আর কখনো নামাজ ফেলে দেবে না, কোরআনের প্রতি উদাসীন হবে না।”

রাইহান মাথা নিচু করে বলল, “জ্বী চাচা। আমি প্রতিজ্ঞা করছি।”

সে ঘুরে দাঁড়াল বাড়ির দিকে যেতে। কিন্তু একবার ফিরে তাকিয়ে দেখল, লোকটি কোথাও নেই! কোথায় গেলেন তিনি? সে তো এতোক্ষণ তার সঙ্গেই ছিল!

সে দ্রুত দৌড়ে বাড়ি ফিরে এলো। মা দরজা খুলে চোখে পানি নিয়ে তাকে বুকে টেনে নিলেন। বাবা বললেন, “তুই ঠিক আছিস, আলহামদুলিল্লাহ! আমরা কত খুঁজেছি তোকে!”

রাইহান কাঁদতে কাঁদতে সব কথা খুলে বলল। মা চুপচাপ শুনে বললেন, “আল্লাহ একজন ফেরেশতা পাঠিয়ে তোকে রক্ষা করেছেন, বাবা। কত বড় নিয়ামত! এখন তো বুঝলি—আল্লাহ কখনো আমাদের ছেড়ে দেন না।”

সেই দিন থেকে রাইহানের জীবন বদলে গেল। প্রতিদিন সে নামাজ পড়তে লাগল, কোরআন শিখতে লাগল। বন্ধুদেরকেও সে বলত, “আল্লাহর পথে চলো ভাই, এই পথেই শান্তি।”

বছরখানেক পর রাইহান কুরআনের হিফজ শুরু করল গ্রামের মাদরাসায়। মুখে মুখে কোরআনের আয়াত তার হৃদয়কে বদলে দিল। সে জানল, দুনিয়ার কোনো আলো, কোনো খেলাধুলা, কোনো বিনোদন আল্লাহর ভালোবাসার মতো শান্তি দিতে পারে না।

রাইহান বড় হয়ে একজন ইসলামি স্কলার হলো। সে শুধু কিতাব নয়, মানুষের হৃদয়কেও জয় করল। সে সবসময় বলত, “যে অন্ধকার বনের মাঝে আমি পথ হারিয়ে ছিলাম, তা-ই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। হয়তো আমি পথ হারিয়েছিলাম, কিন্তু আল্লাহর রহমত আমাকে ঠিক পথ দেখিয়ে দিয়েছিল।”


শিক্ষা:

এই গল্পটি আমাদের শেখায়—

  1. নামাজ ও কোরআনের প্রতি যত্নবান হওয়া ইসলামী জীবনের প্রথম ধাপ।

  2. আল্লাহর রহমত কখনোই তার বান্দাদের ছেড়ে দেয় না, বিশেষ করে যারা সত্যিকার অর্থে ভুল বুঝতে পারে।

  3. শিশু বয়স থেকেই ইসলামি শিক্ষা দেওয়া ভবিষ্যতের আলোকিত প্রজন্ম গড়তে সাহায্য করে।

  4. একটি ভুল অভিজ্ঞতা জীবন বদলে দিতে পারে, যদি তা থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.