আমানতের আলো
আমানতের আলো
মদিনার উপকণ্ঠে ছোট্ট একটি গ্রামে বাস করত এক বালক, নাম তার হাসান। বয়স মাত্র ১২, কিন্তু তার অন্তরে ছিল এক বিশাল আস্থা ও খোদাভীতি। তার পিতা ছিলেন একজন সৎ কৃষক এবং মাতা একজন ধর্মপ্রাণা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই হাসানকে ইসলামের শিক্ষা দিয়ে বড় করেছেন তারা। বিশেষ করে, আমানতের গুরুত্ব শেখানো হয়েছে ভালোভাবে।
একদিন গ্রামের পাশের বাজারে যেতে হয় হাসানকে। সে কিছু শাকসবজি বিক্রি করে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ করে তার চোখে পড়ে একটি পুরোনো থলে, পথের ধারে পড়ে আছে। কৌতূহলবশত সে থলেটি তুলে দেখে ভিতরে কিছু স্বর্ণমুদ্রা আর একটি মোটা খাতা।
হাসান থমকে যায়। এত স্বর্ণ! কেউ হারিয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কার? পাশে কেউ নেই। সে চিন্তা করে, "এটা তো আমার নয়। আমি এটা নিয়ে যেতে পারি না।"
সে দ্রুত বাড়ি ফিরে গিয়ে ঘটনা খুলে বলে তার বাবাকে। পিতা হাসিমুখে বলেন, “বাহ, আমার ছেলে! তুমি আজ এক বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে। এটা একটি আমানত। ইসলাম বলে, আমানতের খিয়ানত হারাম। এখন আমাদের উচিত, যার জিনিস সে যেন পায় তা নিশ্চিত করা।”
পরদিন হাসান ও তার পিতা সেই থলেটি নিয়ে গ্রামের মসজিদের ইমামের কাছে যান। ইমাম সাহেব থলেটি ভালোভাবে দেখেন এবং খাতাটি পড়ে বুঝতে পারেন যে, এটি একজন যাত্রী বা ব্যবসায়ীর জিনিস। খাতায় কিছু নাম ও তারিখ ছিল, যা থেকে অনুমান করা গেল, লোকটি হয়তো পাশের শহর থেকে এসেছেন।
ইমাম ঘোষণা দেন জুমার খুৎবার সময়, “যদি কেউ তার মূল্যবান জিনিস হারিয়ে থাকেন, তাহলে মসজিদে এসে যোগাযোগ করুন।”
এই ঘোষণা চলতে থাকে তিন সপ্তাহ। কিন্তু কেউ আসেনি।
একদিন, মসজিদে এক অচেনা ব্যক্তি এসে বললেন, “আমি আমার মাল হারিয়ে ফেলেছি গত মাসে। আমার একটি থলে ছিল, তাতে কিছু স্বর্ণ ও একটি ব্যবসায়িক খাতা ছিল।”
ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার থলেটি কেমন ছিল?”
লোকটি হুবহু বর্ণনা দেন – থলের রঙ, খাতার পাতায় আঁচড়ের দাগ, এমনকি কয়টি মুদ্রা ছিল তাও বলে দেন।
ইমাম হাসিমুখে বলেন, “আলহামদুলিল্লাহ! আপনার মাল পাওয়া গেছে। এটা পেয়েছিল আমাদের ছোট্ট ভাই হাসান। সে কিন্তু একটুও নেনি, শুধু তোমার মাল ফিরিয়ে দিতে চেয়েছে।”
লোকটি বিস্মিত! সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। “এত সৎ বালক আমি আগে দেখিনি। এই আমানতের প্রতি এই বয়সেই এত খেয়াল! আমি তো ভেবেছিলাম মাল চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি।”
সে হাসানকে সামনে এনে বলে, “বাবা, তুমি চাইলে এসব টাকা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারতে, কিন্তু তুমি মহান আল্লাহকে ভয় করেছো। আমি তোমাকে কিছু পুরস্কার দিতে চাই।”
হাসান মাথা নিচু করে বলেন, “চাচা, আমি কেবল আমার দায়িত্ব পালন করেছি। আমি যা করেছি, তা আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.) শিখিয়েছেন।”
লোকটি হাসে। “তোমার এই কথাই সবচেয়ে বড় পুরস্কার। কিন্তু আমার ব্যবসা এত বড় যে, আমি তোমার পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে চাই। তুমি যদি রাজি থাকো, আমি তোমার শিক্ষার জন্য একটি ব্যবস্থা করতে চাই মদিনায়, যাতে তুমি আরও বড় হতে পারো এবং এই সততার শিক্ষা আরও ছড়িয়ে দিতে পারো।”
হাসানের বাবা-মা অনুমতি দেন। হাসান পরবর্তী বছর মদিনায় যায় এবং একটি ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রে ভর্তি হয়। সেখানে সে কুরআন, হাদীস, ইসলামি আইন ও চরিত্র গঠনের নানা শিক্ষা গ্রহণ করে।
বছর পেরিয়ে যায়। হাসান বড় হয়ে এক জ্ঞানী আলেমে রূপান্তরিত হন। তিনি ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেন অনেক দূর-দূরান্তে। মানুষ তার কথা শুনে অনুপ্রাণিত হয়, বিশেষত যুবকরা। কারণ, তিনি ছিলেন এমন একজন, যিনি শৈশবেই আল্লাহর ভয় এবং সততা নিজের জীবনে ধারণ করেছিলেন।
গল্পের শিক্ষা:
-
আমানত একটি মহান দায়িত্ব। যে তা পালন করে, সে আল্লাহর কাছে প্রিয় হয়।
-
সততা ও খোদাভীতি ছোট বয়স থেকেই চর্চা করলে, তা ভবিষ্যতে ব্যক্তিকে মহান করে তোলে।
-
ইসলামের নৈতিক শিক্ষা আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আলোর পথ দেখায়।
কোন মন্তব্য নেই