Header Ads

আলোপথে হাঁটা এক ছেলের গল্প

 আলোপথে হাঁটা এক ছেলের গল্প। 

 


 নাম তার রফিক। বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম তার। চারদিকে সবুজ ধানের ক্ষেত, কাঁচা মাটির রাস্তা আর সন্ধ্যাবেলায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক – এমন এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে বড় হলেও রফিকের জীবনটা ছিল প্রকৃতির সেই সৌন্দর্যের বিপরীত। বাবা একজন দিনমজুর, মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। দুই বেলার ভাত জোটাতে হিমশিম খেতে হতো পরিবারটিকে।

রফিক ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী ছিল। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে তার শিক্ষকদের নজরে পড়ে যায় সে। শিক্ষকরা বলতেন, “এই ছেলে একদিন বড় কিছু করবে।” কিন্তু গরিবি তার সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। স্কুলে বই-খাতা কেনার টাকা থাকত না, অন্যের পুরনো বই দিয়ে পড়তে হতো। অনেক সময় খালি পেটে স্কুলে যেতে হতো, কখনো আবার টিফিনের সময় এক কোণায় বসে থাকতে হতো, কারণ খাবার ছিল না।

একদিন স্কুল থেকে ফিরেই দেখে তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দিনমজুরির কাজ করতে গিয়ে কোমরে আঘাত পেয়েছেন। এরপর পরিবারে উপার্জনের একমাত্র পথ বন্ধ হয়ে যায়। মা অল্প টাকায় আরও বেশি সময় কাজ করতে বাধ্য হন। রফিক তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র, কিন্তু পরিস্থিতি তাকে বইয়ের বদলে গামলা ধরতে বাধ্য করল। সকালবেলা বাসি চোখে স্কুলে গিয়ে, বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি হাটে হকারের কাজ করত সে। বাড়ি ফিরে মায়ের হাতের রান্না নয়, অনেক সময় এক বাটি ভাতের সাথে লবণ দিয়েই খেতে হতো।

তবে রফিক হাল ছাড়েনি। রাতে হারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করত। তার মায়ের একটাই স্বপ্ন ছিল – “ছেলেটা যেন আমাদের মতো না হয়, লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়।” এই কথাগুলো রফিকের মনে গেঁথে গিয়েছিল। তাই যতই কষ্ট হোক, সে লেখাপড়ার সাথে আপস করেনি।

জেএসসি পরীক্ষায় সে স্কুলে প্রথম হয়। সবাই অবাক হয়, এমন কষ্টের মধ্যেও এমন রেজাল্ট! শিক্ষকরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। কেউ বই দেয়, কেউ ফি মাফ করিয়ে দেয়। এভাবেই রফিক এসএসসি পর্যন্ত পৌঁছায়। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে আবারও এক বড় ধাক্কা খায় সে। তার মা একদিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে যান। হাসপাতালে নিতে হয়। চিকিৎসার খরচ জোগাতে রফিক তার বই বিক্রি করে দেয়, হাটে আরও বেশি সময় কাজ শুরু করে।

এই সময়টায় রফিক মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়ে। পড়াশোনায় মন বসত না, ক্লান্ত শরীরে বই খোলা কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। তবুও সে থামেনি। সময় ভাগ করে চলে – সকালে স্কুল, দুপুরে হাটে কাজ, রাতে পড়াশোনা। এসএসসি পরীক্ষায় সে জিপিএ-৫ পায়। গ্রামে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। সবাই বলে, “রফিক আমাদের গ্রামের গর্ব।”

এই সাফল্যের পর সে কলেজে ভর্তি হয়। কিন্তু কলেজে এসে বুঝে আরও বড় সংগ্রামের সামনে সে। শহরে যাতায়াতের টাকা নেই, খাওয়া-দাওয়া অনিয়মিত, আর একাকিত্বে ভুগতে থাকে সে। তবুও সে নিজের স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে। ইন্টারনেট ক্যাফেতে গিয়ে কম্পিউটার শেখে, বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়াশোনা করে। কিছু শিক্ষক আবার তাকে কোচিংয়ের সুযোগ দেন বিনা পয়সায়।

এইভাবেই এই ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। অনেকগুলো পরীক্ষায় অংশ নিয়ে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। তার চোখে তখন নতুন স্বপ্ন – “আমি শিক্ষক হব। গ্রামের ছেলেমেয়েদের শেখাবো, যেন কেউ শুধু গরিব বলে পিছিয়ে না পড়ে।”

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে রফিক প্রথমবারের মতো একটু স্বস্তি পায়। স্কলারশিপ পায়, কিছু পার্ট-টাইম কাজ পায়। মাকে হাসপাতালে দেখিয়ে আনে, বাবার চিকিৎসা করায়। বাড়িতে টাকা পাঠাতে শুরু করে। আর নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যায় নিষ্ঠার সাথে।

চার বছর পর, সেই গরিব ঘরের ছেলে গ্র্যাজুয়েট হয়। প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। এরপর বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেয়। কঠিন সংগ্রামের ফল মেলে – সে প্রথমবারেই উত্তীর্ণ হয় এবং শিক্ষক ক্যাডারে নিয়োগ পায়।

গ্রামে ফিরে আসে সে, সরকারি কলেজে শিক্ষক হয়ে। সেদিন গ্রামের মানুষ তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়। কেউ আর তাকে গরিব রফিক বলে ডাকে না, সবাই বলে, “স্যার রফিক।”

একদিন সে তার পুরনো স্কুলে গিয়ে দাঁড়ায়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দেখে নিজের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। সে চোখ ভেজা কণ্ঠে বলে,

“তোমরা স্বপ্ন দেখো, কখনো হাল ছেড়ো না। গরিব হওয়া লজ্জার নয়, যদি তুমি মনের দিক থেকে ধনী হও।”

তার কষ্টের গল্প তখন আর শুধু তার একার থাকে না। সেটা হয়ে ওঠে গ্রামের শিশুদের অনুপ্রেরণা।


উপসংহার:

রফিকের গল্প কেবল এক গরিব ছেলের কষ্টের বিবরণ নয়, এটা দৃঢ় মনোবল, শ্রম আর বিশ্বাসের এক মহাকাব্য। সে প্রমাণ করে, সামান্য ঘরের ছেলেও আকাশ ছুঁতে পারে, যদি মনের মধ্যে স্বপ্ন আর চোখে অগ্নি জ্বলে। তার জীবনের সংগ্রাম আমাদের শেখায়—চেষ্টা করলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।

 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.