Header Ads

এক মুঠো খেজুর

 এক মুঠো খেজুর


এক.

মদিনার উপকণ্ঠে ছোট্ট এক গ্রামে থাকত এক গরিব কৃষক—ইসমাইল। সারা বছর মাঠে কাজ করে যা পেত, তা দিয়ে স্ত্রী আমিনা আর ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোনোরকমে দিন কাটত। শীত হোক বা গ্রীষ্ম, ইসমাইল কখনো সালাত মিস করত না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সময়মতো আদায় করত এবং তাঁর স্ত্রীও ছিল খুব ধর্মভীরু।

একদিন গ্রামের মসজিদের ইমাম ঘোষণা দিলেন, “এই রমজানে মসজিদে ইফতার আয়োজন করা হবে। যার যা সামর্থ্য, খেজুর বা পানি দান করুন।”

ইসমাইল ঘরে ফিরে এসে স্ত্রীকে বলল,
—“আমিনা, আমাদের কিছু খেজুর আছে?”
—“মাত্র এক মুঠো, ওটা তো ছেলেমেয়েদের জন্য রেখেছিলাম।”

ইসমাইল স্ত্রীর দিকে তাকাল, চোখে মায়া আর বিশ্বাস,
—“আল্লাহর রাস্তায় কিছু দিলে কখনো কমে না, বরং বাড়ে।”

আমিনা একটু দ্বিধায় থাকলেও বিশ্বাসের টানে সম্মতি দিল। ইসমাইল সেই এক মুঠো খেজুর ইমামের হাতে দিলেন। ইমাম খুশি হয়ে দোয়া করলেন:
—“আল্লাহ যেন এই খেজুরের বিনিময়ে তোমার রিজিক বাড়িয়ে দেন।”

দুই.

রমজানের শেষ দশ দিন চলছিল। এক রাতে ইসমাইল ইতিকাফে বসতে গেলেন মসজিদে। মসজিদে শান্ত পরিবেশ, কুরআনের তিলাওয়াত, দোয়া আর কান্নায় ভেসে যায় রাতগুলো।

তখনই ইসমাইল এক রাতে স্বপ্নে এক জ্যোতির্ময় মুখের অধিকারী বৃদ্ধকে দেখল। বৃদ্ধ বলল,
—“হে ইসমাইল, আল্লাহ তোমার খেজুর গ্রহণ করেছেন। তুমি কাল দক্ষিণ দিকের পাহাড়ের গায়ে গিয়ো, সেখানে তোমার জন্য এক নিয়ামত অপেক্ষা করছে।”

ইসমাইল ঘুম থেকে উঠে চমকে গেল। তার চোখ ভেজা, মুখে প্রশান্তির ছায়া।

পরদিন সকালে ফজরের নামাজ শেষে, সে কোনো দ্বিধা না করে দক্ষিণের পাহাড়ের দিকে রওনা দিল।

তিন.

পাহাড়ে পৌঁছে ইসমাইল কিছুক্ষণ খুঁজে খুঁজে এক জায়গায় দাঁড়াল যেখানে কিছুটা নরম মাটি ছিল। কৌতূহলবশত হাতে থাকা কুড়াল দিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করল। কিছুক্ষণ পর সে এক ঝকঝকে সিন্দুক দেখতে পেল! অবিশ্বাস্য! সিন্দুকটি খুলতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ভেতরে ছিল সোনার দীনার আর রূপার মোহর, কিছু প্রাচীন অলঙ্কার এবং একটি পুরোনো চিঠি।

চিঠিতে লেখা ছিল:
“যে এই সম্পদ পাবে, সে যেন আল্লাহর পথে খরচ করে, এতিমদের আশ্রয় দেয় এবং মসজিদ নির্মাণে অংশ নেয়। এতে সে জান্নাতে মহান প্রতিদান পাবে।”

ইসমাইল আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। সে জানত, এটা তার জন্য একটি পরীক্ষা—ধন না, বরং ধনের সঠিক ব্যবহার।

চার.

ইসমাইল গ্রামে ফিরে এসে কাউকে না জানিয়ে ইমামের সঙ্গে গোপনে পরামর্শ করল। ইমাম বললেন,
—“এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ামত। তুমি যদি খোদার রাস্তায় খরচ করো, তোমার জন্য আরো বড় কিছু অপেক্ষা করছে।”

ইসমাইল প্রথমেই গ্রামের দরিদ্রদের মাঝে রেশন বিতরণ করল। তারপর গ্রামের কাচা রাস্তা পাকা করার জন্য অর্থ দিল। এবং মসজিদের পাশে একটি মক্তব তৈরি করল যাতে এতিম শিশুদের পড়াশোনা হয়।

গ্রামের লোকেরা অবাক হয়ে গেল। এত বছর যাকে গরিব কৃষক হিসেবে জানত, সে কিভাবে এত দান করতে পারছে?

ইসমাইল সবসময় বলত,
—“আমি কিছুই নই। যা করেছি, সব আল্লাহর। আমি তো শুধু এক মুঠো খেজুর দিয়েছিলাম, আল্লাহ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন অগণিত নিয়ামত।”

পাঁচ.

ইসমাইলের খ্যাতি ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। দূর-দূরান্তের লোকেরা এসে তার কাছে সাহায্য চাইত। কিন্তু ইসমাইল কখনো অহংকার করেনি, বরং দান করে নিজে গোপনে কান্না করত।

একদিন ইসমাইলের কাছে এক দরিদ্র যুবক এল। তার মা অসুস্থ, চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার। ইসমাইল কিছু না বলে তার হাতে অর্থ তুলে দিল।

যুবক বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
—“হুজুর, আপনি তো একজন সাধারণ কৃষক ছিলেন। আজ আপনি সবাইকে দান করছেন, কিন্তু নিজের জন্য তো কিছু রাখছেন না?”

ইসমাইল মুচকি হেসে বলল,
—“আমি যা রেখেছি, তা এখানে নয়—আখিরাতে রেখেছি। কারণ রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘মানুষ যা খায়, পরে তা শেষ হয়ে যায়; যা পরে পড়ে, তা অন্যের হয়; আর যা দান করে, তাই প্রকৃত সম্পদ।’”

ছয়.

বছর কেটে গেল। ইসমাইলের বয়স বাড়তে থাকল। একদিন সে তার সন্তানদের ডেকে বলল,
—“তোমরা যদি সত্যিকারের সম্পদ চাও, তবে বেশি কিছু চাইবে না, বরং বেশি দান করবে। মানুষ যখন দেয়, তখন সে বড় হয়, আর যখন চায়, তখন সে ছোট হয়ে যায়।”

তার মৃত্যুর আগের দিন সে আবার সেই জ্যোতির্ময় বৃদ্ধকে স্বপ্নে দেখল। বৃদ্ধ বলল,
—“তুমি তোমার খেজুরের দায়িত্ব পালন করেছ। তোমার জন্য জান্নাতে এক বিশাল বাগান প্রস্তুত। তোমার বাম হাতে যা ছিল, তা দিয়ে তুমি ডান হাতকে জানতেও দাওনি। তুমি সফল হয়েছ।”

সকালবেলা ইসমাইল দুনিয়া থেকে বিদায় নিল—শান্তভাবে, নিঃশব্দে, কিন্তু স্মৃতিতে অমর হয়ে।


শেষ কথা:

ইসমাইলের গল্প আমাদের শেখায়, ছোট কিছু দানও যদি হয় একনিষ্ঠতার সঙ্গে, আল্লাহ তাতে অগণিত বরকত দেন। দান শুধু ধন-সম্পদের নয়, ভালোবাসা, সময়, জ্ঞান—সবই হতে পারে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই “এক মুঠো খেজুর” দেওয়ার তৌফিক দিন, যা আখিরাতে জান্নাতের বাগানে পরিণত হবে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.