Header Ads

মানবতার আলো



 গল্পের নাম: “মানবতার আলো”

 


 
একটি ছোট গ্রামে থাকত একটি কিশোর, নাম রাহুল। সে ছিল খুবই দারিদ্র্য পীড়িত পরিবারের সন্তান। বাবা একজন কৃষক, মা গৃহিণী। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে সে মাঠে গিয়ে বাবার সাথে কাজ করত। তবুও কখনো ক্লাস বাদ দিত না। পড়ালেখার প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা ছিল।

রাহুলের শিক্ষকরা তাকে খুবই ভালোবাসতেন। তার মেধা, শৃঙ্খলা ও বিনয় তাদের মুগ্ধ করত। কিন্তু গ্রামের অনেক ছেলেই তার ওপর হিংসা করত। তারা ভাবত, এত গরিব হয়েও কীভাবে সে এত ভালো রেজাল্ট করে। অনেকেই তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত। কিন্তু রাহুল কখনো কারো কথায় ভেঙে পড়ত না। সে বলত, “আমি জানি আমি কী করতে চাই। বাকিদের মতামত নয়, নিজের ইচ্ছা আর সৎ পথই আমাকে এগিয়ে নেবে।”

একদিন স্কুলে বিজ্ঞান মেলা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষকরা ঘোষণা দেন, যার প্রকল্প সেরা হবে, সে একটি শহরের বড় স্কুলে স্কলারশিপ পাবে। রাহুল খুব উত্তেজিত হয়। কিন্তু তার কাছে কোনো উপকরণ ছিল না। গ্রামের বাজারেও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পাওয়া যেত না।

তখন রাহুল এক অসম্ভব সিদ্ধান্ত নেয়। সে পুরনো ইলেকট্রনিকস, ভাঙা খেলনা, বাতিল বোতল আর কাগজ দিয়ে তৈরি করে “সৌর শক্তিতে চলা একটি ছোট জল পরিশোধন যন্ত্র”। প্রকল্পটি সে নিজের ঘরের সামনে বসে রাতদিন খেটে তৈরি করে। তার বাবা-মা প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন — “ছেলেটা এত সময় পড়ার বাইরে দিচ্ছে কেন?” কিন্তু পরে যখন রাহুল বোঝাল এটা তার জীবনের একটা সুযোগ, তারা তাকে উৎসাহ দিলেন।

বিজ্ঞান মেলার দিন, অনেকেই হেসে বলল, “ও কি বোতলের সাথে খেলছে?” কিন্তু শিক্ষকরা যখন তার প্রকল্পের কার্যকারিতা দেখলেন, তখন তারা অভিভূত হয়ে গেলেন। রাহুল প্রথম পুরস্কার পেল, এবং শহরের বড় স্কুলে স্কলারশিপও।

শহরে গিয়ে রাহুলের সামনে খুলে গেল নতুন এক জগত। কিন্তু এখানে আবার শুরু হলো আরেক সংগ্রাম। বড়লোক ছাত্ররা তাকে তাচ্ছিল্য করত, কারণ তার পোশাক পুরনো, তার ইংরেজি উচ্চারণ নিখুঁত নয়, সে প্রতিদিন স্কুলের বাস ধরার জন্য অনেক দূর হাঁটে।

রাহুল মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে পড়ত, কিন্তু তখন তার গ্রামের কথা মনে পড়ত। তার বাবা-মার কষ্ট, তার ছোট বোনের স্বপ্ন—সব কিছুই তাকে নতুন করে জ্বালানি দিত। সে পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হলো। সময় পেলেই লাইব্রেরিতে পড়তে যেত, নিজে নিজে ইংরেজি শেখার চেষ্টা করত, বিজ্ঞানের নানা বিষয় বুঝতে রাতজেগে পড়ত।

কিছু শিক্ষক রাহুলের আন্তরিকতা দেখে তার পাশে দাঁড়ালেন। তারা তাকে প্রজেক্ট গাইড করতেন, ইংরেজিতে সাহায্য করতেন। সময়ের সাথে রাহুল হয়ে উঠল এক উজ্জ্বল তারকা। একদিন সে একটি জাতীয় বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করল। তখন সবাই বুঝল, গরিব ঘরের ছেলে হলেও রাহুল সত্যিই প্রতিভাবান।

বছর কয়েক পর, রাহুল বিদেশে স্কলারশিপে পড়তে গেল। সেখানে সে একটি নতুন পানিশোধন প্রযুক্তি আবিষ্কার করে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি লাভ করল। কিন্তু সে নিজের শিকড় ভুলল না।

দেশে ফিরে সে তার গ্রামে একটি ছোট কারখানা স্থাপন করল, যেখানে গ্রামের যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর বানানো হতো। সে গ্রামের স্কুলের জন্য নতুন ল্যাব তৈরি করল, যেখানে ছেলেমেয়েরা হাতে-কলমে বিজ্ঞান শিখতে পারত। রাহুল বলত, “আমার মতো আর কেউ যেন শুধুমাত্র দারিদ্র্যের কারণে স্বপ্ন বিসর্জন না দেয়।”

তার সাফল্য শুধু তার নিজের ছিল না, বরং একটি গোটা সমাজকে জাগিয়ে তুলেছিল। মানুষ বুঝল, সম্পদ নয়, ইচ্ছাশক্তি আর নৈতিকতা সবচেয়ে বড় শক্তি।

একদিন এক সাংবাদিক রাহুলকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি এই সব কিছুর প্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছেন?”

রাহুল মুচকি হেসে বলল, “আমার প্রেরণা আমার বাবা, যে গরমে ঘাম ঝরিয়ে চাষ করতেন তবু কোনোদিন অন্যায় করেননি; আমার মা, যিনি নিজের খাবার কম খেয়ে আমার খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন; আর আমার ছোট গ্রাম, যেখানে অভাব ছিল, কিন্তু ভালোবাসা আর স্বপ্নের কোনো অভাব ছিল না।”


শিক্ষণীয় বার্তা:
এই গল্প আমাদের শেখায়, মানুষ যদি সত্যিকারের পরিশ্রম করে, বিশ্বাস রাখে নিজের ওপর এবং ভালো পথে থাকে, তাহলে কোনো বাধাই তাকে থামাতে পারে না। আর শিক্ষা ও মানবতা—এই দুটিই পারে সমাজকে বদলে দিতে।

 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.